বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিলেট সার্কেলে কর্মরত মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী। এই কর্মকর্তাকে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেল থেকে নং-৩৫.০৩.০০০০.০১.০১৯.০২২ (অংশ-১)/২০১৮-৪১১২ সংখ্যক স্বারক মূলে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেলে বদলী করে কর্তৃপক্ষ। তবে পছন্দের সার্কেলে বদলী হতে না পেরে কব্জির জোড় দেখিয়ে ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলে মোটরযান পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কুমিল্লা সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আশরাফ সিদ্দিকী মান্নান এর সাথে সিন্ডিকেট গড়ে কুমিল্লা বিআরটিএর একছত্র দালাল নিয়ন্ত্রক বনে যান আব্দুল বারী। বদলী আদেশের প্রায় একবছর ধরে আদেশ উপেক্ষা করে কুমিল্লা বিআরটিএতে তার ঘুষ বাণিজ্য চালালেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ।
অন্য দিকে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নং-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.০৭৮.২০-১৪৯২ স্বারক মূলে আব্দুল বারীর সিন্ডিকেট সদস্য তার পছন্দের মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ চাঁদপুর সার্কেল থেকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় কর্তৃপক্ষ। আব্দুল বারী বিদায় নিয়ে চলে যান বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেলে। রিয়াজুল ইসলাম যেহেতু সহকারী পরিচালক (চঃ দাঃ) দায়িত্ব পাওয়ার সময় ছিল সেহেতু দুইজনে সিন্ডিকেট গড়ে কাজ করার সুবিধার্থে রিয়াজুল যেখানে দায়িত্ব পাবে সেখানে আব্দুল বারী মোটরযান পরিদর্শকের দায়িত্ব নিবে এমন পরিকল্পনা তৈরি করেন এই দুই কর্মকর্তা।
পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়ে নীতিমালা লঙ্গন করে বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেল থেকে সিলেট সার্কেলে বদলী করে বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ। সিলেট সার্কেলে সেই সময়ে সহকারী পরিচালকের (ইঞ্জিঃ) দায়িত্ব পালন করতেন বর্তমান বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলের উপ-পরিচালক সানাউল হক। বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের নানান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গেল বছরের ০৯ এপ্রিল সিলেটে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তবে সকলের অনুরোধে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট স্থগিত করলেও শ্রমিক আন্দোলন এর চাপে একই মাসের ১২ এপ্রিল বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের এক আদেশে সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সানাউল হককে সিলেট সার্কেল থেকে মাগুরা সার্কেলে বদলি করা হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিয়াজুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার লিষ্টে থাকায় উপর মহলে তদবীর করে চলতি গেল বছরের ১২ এপ্রিল নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৬৩১ নং আদেশ মূলে বিআরটিএ সিলেট ও সুনামগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরচিালক (ইঞ্জিঃ) চঃ দাঃ হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেন ।
এরই মধ্যে ঘুষ বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়তে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলী হতে পরামর্শ দেয় রিয়াজুল ইসলাম। পরামর্শ পেয়ে কব্জির জোড়ে বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগকে ম্যানেজ করে ২০ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ মে নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৮০৭ নং স্বারক মূলে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেল থেকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলী হয়ে আসেন আব্দুল বারী। বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ কর্মকর্তাদের বদলীর বিষয়ে নীতিমালার কথা মুখে বললেও প্রভাবশালী ও ঘুষ দুর্নীতিতে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ দালাল নিয়ন্ত্রক এই আব্দুল বারীদের বিষয়ে নীতিমালা মানেন না বলে মাঠ পর্যায়ের স্বচ্ছ কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। তবে এইসব বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগের কেউ নেই বলে সুরমা ভিউকে জানান বিআরটিএর ডজন খানেক মোটরযান পরিদর্শক। সকলের বক্তব্য আব্দুল বারীর কুমিল্লা সার্কেল থেকে কুষ্টিয়া সার্কেল সর্বশেষ কুষ্টিয়া থেকে সিলেট সার্কেল বদলীতে কোন নীতিমালা মানা হয়নি।
সিলেট সার্কেলে বদলী হয়ে দালাল নিয়ন্ত্রণ, ঘুষ বাণিজ্যসহ সব ধরনের অপকর্ম নিজ হাতে তুলে নেন আব্দুল বারী। সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) রিয়াজুল ইসলাম, মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী, মেক্যানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট সাদিকুর রহমান ও অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম মিলে সিলেট বিআরটিএতে তৈরি করেন ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম দুর্নীতির আতুড় ঘর।
তারই ধারাবাহিকতায় ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধনের নামে ৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা করেন এই ৪ কর্মকর্তা কর্মচারী।
এইদিকে গত ২২শে ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এইসব বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হলে ২৭শে ডিসেম্বর বিভাগীয় তদন্তের জন্য আদেশ দেয়া হলেও এখনো পর্যন্ত কোন তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারে নি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এরপর এই বছরের ১৮ই ফেব্রুয়ারী সিলেট জেলা সিএনজি চালিত অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি মোঃ জাকারিয়া আহমদ ঘুষ,দুর্নীতি বন্ধ এবং রিয়াজুল ও আব্দুল বারীকে অপসারণের জন্য ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিলেও এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছেন তারা।
যেইভাবে হয় অবৈধ লেনদেন : যেকোনো ধরনের কাজের জন্য বিআরটিএতে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ হয় এবং তারপর ফিঙ্গার দিতে হয়। কিন্তু এর আগের দিন কাগজপত্র নিয়ে বিআরটিএ অফিসে গিয়ে একটি মার্ক করা লাগে। এই মার্ক করতে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এস এম সামিউল ইসলামের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নেওয়া হয়। এরপর দালালদের মাধ্যমে কাগজপত্রে ঘুষের মার্ক করানো লাগে। কাগজে মার্ক করা হয় ১, ২, ৩ করে। মানে এক হলে ১ হাজার টাকা, দুই হলে ২ হাজার টাকা। এক-পাঁচ দিলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। গাড়িতে কোনো সমস্যা থাকলে সেটিও দালালের মাধ্যমে অবজেকশন দেওয়ানো হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বিনিময়ে। লাইসেন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার। অস্থায়ী ফিঙ্গারের রোলের জন্য দিতে হয় ১ হাজার টাকা। সরকারি ফির বাইরে ফিটনেস পরীক্ষায় প্রতি সিএনজি বাবদ ঘুষ রাখা হয় ২ হাজার টাকা, বড় গাড়ি ৩ হাজার, ট্রাক সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
এই বিষয়ে জানতে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) রিয়াজুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। অন্য দিকে মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। দাপ্তরিক কাজের খুব একটা চাপ না থাকায় সিলেটে কোন পরিচালক না থাকায় রাজত্ব কায়েম করছেন রিয়াজুল। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিআরটিএ পরিচালক মাসুদ আলম সিলেটে অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
এই ব্যাপারে বিআরটিএ চেয়ারম্যান, গৌতম চদ্র পাল প্রতিবেদককে মুঠোফোনে জানান,তিনি গত জুলাই মাসে দ্বায়িত্ব নিয়েছেন। এইসব বিষয়ে তিনি অবগত নয়,খোজ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।